আর এখন চলছে সরকার গঠনের ‘অঙ্ক’। নায়কের পেখমে সঙ্গী (জোট) খোঁজার শিহরণে দুলছেন দুই পার্শ্বনায়ক-নওয়াজ শরিফ, বিলাওয়াল ভুট্টো। একই সঙ্গে চাঙা হয়ে উঠেছে দেশটির সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের ডাকে তেহরিক-ই ইনসাফের (পিটিআই) ফলাফলে কারচুপির বিরুদ্ধে দেশব্যাপী বিক্ষোভের ‘সিনেমা’। কিছুটা ডকুমেন্টারি ফিল্মের ধাঁচে-শান্তিপূর্ণ।
মেরুদণ্ডহীন গণতন্ত্রে সেনাদের বুট-বুলেটের আগ্রাসী অস্তিত্বের প্রতিফলন আবারও ভেসে উঠেছে দেশটিতে। রোববার পর্যন্ত পুরো দুদিন পার হলেও পূর্ণ ফল প্রকাশ পায়নি। টালমাটাল দিশেহারা পাকিস্তানে এ নিয়েই চলছে নিন্দা, সমালোচনা, বিক্ষোভ। এমন টানাপোড়নের মধ্যেই চলছে জোট সরকার গঠনের দৌড়ঝাঁপ।
জোটের খোঁজে একে অপরের সাহারা হয়েছেন পাকিস্তান মুসলিম লীগ-নওয়াজ (পিএমএল-এন) দলের নেতা নওয়াজ শরিফ এবং পাকিস্তান পিপলস পার্টির (পিপিপি) নেতা বিলাওয়াল ভুট্টো। রীতিমতো টানাটানি শুরু হয়েছে দেশটির প্রধানমন্ত্রী পদ নিয়ে। টানাহ্যাঁচড়া চলছে সরকার গঠন বাসনা নিয়ে। কে বেশি আসন পেল-সেটা বড় কথা নয়। সরকারে যেতে চায় তিন দলই। প্রধানমন্ত্রী হতে চান তিন মঞ্চের তিন নায়কই।
জয়ের আসন সংখ্যা পূর্ণ করতে না পেরে নওয়াজ শরিফের দল পিএমএল-এন জোট সরকার গঠনের দৌড়ে পিপিপির সঙ্গে ব্যাপক দরকষাকষি শুরু করেছে। রোববার দেশটির সংবাদমাধ্যম দ্য নিউজ ইন্টারন্যাশনাল জানিয়েছে, দুই দলের নেতাদের বৈঠকে পিপিপিকে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট, জাতীয় পরিষদের স্পিকার ও সিনেটের চেয়ারম্যান পদ দেওয়ার প্রস্তাব দিয়েছে পিএমএল-এন। কিন্তু পিপিপির চেয়ারম্যান বিলাওয়াল ভুট্টো জারদারিকে প্রধানমন্ত্রী বানানোর শর্তেই শুধু পিএমএল-এনের সঙ্গে পিপিপি সমঝোতায় রাজি হবে বলে জানিয়েছেন। সরকার গঠনের অসীম উচ্ছ্বাসে ভাসছে ইমরান খানের পিটিআইও।
পাকিস্তানে ৮ ফেব্রুয়ারি জাতীয় নির্বাচনের পর নতুন সরকার গঠন নিয়ে পাকিস্তান মুসলিম লীগ-নওয়াজের (পিএমএল-এন) এবং পাকিস্তান পিপলস পার্টির (পিপিপি) শীর্ষ নেতারা রাজনৈতিক সমঝোতার বিষয়ে একমত হয়েছেন। রোববার পিএমএল-এন ও পিপিপির নেতারা প্রথম আনুষ্ঠানিক বৈঠকে বসেন। লাহোরে পিপিপির চেয়ারম্যান বিলাওয়াল ভুট্টো জারদারির বাসভবনে পিএমএল-এন-এর প্রেসিডেন্ট শাহবাজ শরিফ দলের জ্যেষ্ঠ নেতাদের নিয়ে যান। সেখানে দুই পক্ষ দেশের বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেন।
বৈঠকের পর পিএমএল-এন ও পিপিপি যৌথ বিবৃতিতে বলে, পিএমএল-এন প্রেসিডেন্ট শাহবাজ শরিফের নেতৃত্বে পিএমএল-এনের প্রতিনিধি দল পিপিপি চেয়ারম্যান বিলওয়াল ভুট্টো জারদারি ও কো-চেয়ারম্যান আসিফ আলী জারদারির সঙ্গে বৈঠকে সরকার গঠনে তাদের সহযোগিতা চেয়েছেন। জবাবে পিপিপি নেতৃত্ব পিএমএল-এন নেতাদের বলেছেন, প্রস্তাবটি নিয়ে তাদের দলের কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির (সিইসি) বৈঠকে আলোচনা করা হবে। সোমবার এ বৈঠক হওয়ার কথা রয়েছে।
সেনা বাধা আর বিরোধীদের নানান কৌশল টপকে নির্বাচনি জয়ের দৌড়ে এগিয়ে আছেন খানের দল তেহরিক-ই-ইনসাফ (পিটিআই)। রবিবার ডন ও জিইও নিউজের সর্বশেষ তথ্যানুযায়ী, স্বতন্ত্ররা ১০১টি আসন পেয়েছেন। যার মধ্যে সরাসরি পিটিআই সমর্থিত স্বতন্ত্র প্রার্থীরা পেয়েছেন ৯৩টি আসন। পাকিস্তান মুসলিম লীগ-নওয়াজ (পিএমএল-এন) ৭৫টি। এর মধ্যে অবশ্য পিএমএল ৩টি। পাকিস্তান পিপলস পার্টি (পিপিপি) ৫৪টি এবং মুত্তাহিদা কওমি মুভমেন্ট (এমকিউএম) ১৭টি আসনে জয়ী হয়েছে। দশটি ছোট দল বাকি ১৭টি আসন পেয়েছে। ২ আসনের গণনা স্থগিত করা হয়েছে। পিটিআই ভোটের সব থেকে বেশি আসন নিয়ে সেনা-সমর্থিত পাকিস্তান মুসলিম লীগ-নওয়াজ (পিএমএল-এন)-এর ক্ষমতায় জয়ী হওয়ার সম্ভাবনাকে ধ্বংস করে দিয়েছে।
তবে ফলাফল ঘোষণার বিলম্ব তার সমর্থকদের মধ্যে আশঙ্কার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। পিটিআই নেতাদের দাবি, ভোট কারচুপি না হলে তারা আরও বেশি আসন পেতেন তারা। নির্বাচনের দিন মোবাইল ও ইন্টারনেট পরিষেবা বন্ধ এবং ফলাফলের ধীরগতির গণনা সন্দেহের জন্ম দেয়। ধারণা করা হয় সামরিক সংস্থা পিএমএল-এন-এর সাফল্য নিশ্চিত করার প্রক্রিয়াটিকে প্রভাবিত করতে পারে। যার জেরে রোববার সমর্থকদের শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদ করার আহ্বান জানায় পিটিআই। ফলে শুরু হয় বিক্ষোভ।
নির্বাচনে কথিত কারচুপির বিরুদ্ধে সারা দেশের বিভিন্ন শহরে বিক্ষোভ করেছে পিটিআই নেতারা। রাওয়ালপিণ্ডির সাদিকাবাদে জেলা নির্বাচন কমিশনারের কার্যালয়ের বাইরে বিক্ষোভ করেছে। অনুষ্ঠানে উপস্থিত পুলিশ কর্মীরা বিক্ষোভকারীদের ছত্রভঙ্গ করতে টিয়ার গ্যাস ব্যবহার এবং লাঠিচার্জ করেছে বলে জানা গেছে। পিটিআইয়ের আরও কিছু কর্মী শুক্কুর প্রেস ক্লাবের বাইরেও বিক্ষোভ করেছে। এই বিক্ষোভের নেতৃত্বে ছিলেন এনএ-২০০ এবং পিএস-২৪ থেকে দলের স্বতন্ত্র প্রার্থী গোহর খোসো এবং সাফিয়া বালুচ।
এছাড়া পিটিআই কর্মীদের আরেকটি বিক্ষোভ পাকিস্তানের নির্বাচন কমিশনের (ইসিপি) সিন্ধু অফিসের বাইরে অনুষ্ঠিত হয়েছিল। এদিকে পাঞ্জাবের দক্ষিণের শহর চকওয়ালে রিটার্নিং অফিসারের অফিসের বাইরে বিক্ষোভ করার জন্য পিপি-২২ এবং পিপি-২৩-এর প্রার্থীসহ ৩০০ পিটিআই কর্মীদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেছে পুলিশ।
মামলায় সন্ত্রাস ও সাউন্ড অ্যাক্ট লঙ্ঘনসহ একাধিক অভিযোগ আনা হয়েছে। বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে করাচিতে ও লাহোরেও। সহিংসতা আরও ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কায় ইতোমধ্যে ইসলামাবাদ এবং রাওয়ালপিণ্ডিতে ১৪৪ ধারা জারি করা হয়েছে। বিক্ষোভে তেহরিক-ই-লাব্বাইক পাকিস্তান (টিএলপি) ও জামায়াত-ই-ইসলামী (জেআই)-এই দুই দলও যোগ দেয়।