সবকিছুই চলছে আগের মতো

Date: 2024-02-12
news-banner
প্রতিশ্রুতিতেই আটকে আছেন নতুন সরকারের মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীরা। দায়িত্ব নেওয়ার পরপরই তারা যে কাজগুলো করবেন বলে কথা দিয়েছিলেন তার তেমন বাস্তবায়ন নেই। দু-একটি ব্যতিক্রম ছাড়া গত এক মাসে তেমন সাফল্য নেই। এ সময়ে ওষুধ, চালসহ নিত্যপণ্যের দামে লাগাম পড়েনি। প্রকল্পের যানবাহন ফেরত আনা, যানজট হ্রাস এবং জনপ্রশাসনে তেমন কোনো পরিবর্তন লক্ষ করা যায়নি। 

এমনকি সরকারের অনেক মন্ত্রী কর্মপরিকল্পনাও ঘোষণা করেননি। সবকিছু চলছে আগের মতোই। মজুতদারি ও চাঁদাবাজির বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে বলেছেন প্রধানমন্ত্রী। সচিব সভায় প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, চাঁদাবাজি বন্ধে কারও হুমকি-ধমকি আমলে নেওয়া যাবে না।

তবে ব্যতিক্রমও আছে। পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক মন্ত্রী সাবের হোসেন চৌধুরী, সমাজকল্যাণমন্ত্রী ডা. দীপু মনি, গৃহায়ন ও গণপূর্তমন্ত্রী র আ ম ওবায়দুল মোকতাদির চৌধুরী এবং ডাক, টেলিযোগাযোগ ও প্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক এর ব্যতিক্রম কিছু কর্মপরিকল্পনা হাতে নিয়েছেন। সব মন্ত্রী ও প্রতিমন্ত্রীর সাফ কথা দুর্নীতি সমূলে উৎপাটন করা হবে। এজন্য নেওয়া হবে কার্যকর পদক্ষেপ। 

১১ জানুয়ারি নতুন মন্ত্রিসভা শপথ নেয়। এর দুদিন পর ১৪ জানুয়ারি দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীরা নিজ নিজ মন্ত্রণালয়ে গিয়ে প্রথম দিন সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে বেশ কিছু কাজের কথা বলেন। ১১ ফেব্রুয়ারি নতুন মন্ত্রিসভার এক মাস পূর্ণ হয়েছে।

চালের বাজার নিয়ন্ত্রণে আনতে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদার। ছুটে বেড়াচ্ছেন দেশের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে। কিন্তু তার চেষ্টার ফলাফল এখনো দৃশ্যমান হচ্ছে না। খুচরা বিক্রেতাদের নিয়ন্ত্রণের কোনো কৌশল তার জানা নেই। 

এছাড়া ভরা মৌসুমে চালের বাজারে নৈরাজ্যের পেছনে খাদ্য বিভাগের অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারীদের হাত রয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে। মন্ত্রীও বিষয়টির সঙ্গে একমত পোষণ করে যুগান্তরকে বলেন, আমি তো নির্বাচন নিয়ে ব্যস্ত ছিলাম। কর্তকর্তারা কী নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন। তাদের জিজ্ঞেস করুন, তাদের ধরুন। সব দায় রাজনীতিবিদদের নিতে হবে কেন? 

ভরা মৌসুমে বাজারে সব ধরনের সবজি ও দেশীয় ফলের বাজারমূল্য বেশ চড়া। দায়িত্বভার গ্রহণের পর কৃষিমন্ত্রী আব্দুস শহীদ গণমাধ্যমকে বলেছেন, যারা নিত্যপণ্যের বাজার কারসাজি করে, সিন্ডিকেট করে, তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তাদের গ্রেফতার করে আইনের আওতায় আনা হবে। কিন্তু বাস্তবে মন্ত্রীর কথার কোনো প্রভাব বাজারে পড়েনি। 

বাজার আগের মতোই আপন গতিতে চলছে। এসব দেখভালে কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের দুর্বল তদারকিকে দায়ী করছেন সংশ্লিষ্টরা। তবে এ বিশাল বাজার তদারকির পর্যাপ্ত জনবল নেই সংস্থাটির। ফলে প্রতিদিন ভোক্তার পকেট কাটা যাচ্ছে। 

তেল, চিনি, ডাল, আটা, ময়দা, সুজিসহ যাবতীয় নিত্যপণ্যের বাজার নিয়ন্ত্রণে আসছে না। বর্তমান বাণিজ্য প্রতিমন্ত্রী দায়িত্বভার গ্রহণের আগে নিত্যপণ্যের বাজারদর যা ছিল তার চেয়ে এখন বাড়তির দিকে। আসন্ন মাহে রমজান সামনে রেখে নিত্যপণ্যের বাজার উত্তপ্ত হয়ে উঠছে।

সর্বশেষ রোজায় চালসহ চার পণ্যের আমদানি শুল্ক কমানো হয়। প্রতিমন্ত্রী সম্প্রতি খাদ্য মন্ত্রণালয়ের সম্মেলন কক্ষে রমজানের বাজার নিয়ে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে বলেন, অপেক্ষা করুন এবং দেখুন কী হয়। আমরা কী করতে পারি। আমরা বসে নেই। 

পূর্ণমন্ত্রী হিসাবে দায়িত্বভার গ্রহণের দিন জনপ্রশাসনমন্ত্রী ফরহাদ হোসেন বলেছেন, যদি আর মন্ত্রী না হতাম তাহলে সমাপ্ত প্রকল্পের গাড়ি জমা নিতে না পাড়ার বেদনা হৃদয় মাঝে থেকে যেত। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আমার ওপর আস্থা রেখেছেন, এবার সমাপ্ত প্রকল্পের গাড়ির হিসাব নিতে চাই। তিনি আরও বলেন, আমার আরও একটি অপূর্ণতার জায়গা হলো সরকারি কর্মচারী হাসপাতালের চিকিৎসাসেবার মান উন্নয়ন। 

হাসপাতালটির জন্য পর্যাপ্ত জনবল, যন্ত্রপাতি, টেকনিশিয়ান, অবকাঠামোসহ সার্বিক উন্নয়নে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তিনি আন্তঃক্যাডার বৈষম্য দূরীকরণে ব্যবস্থা নেওয়ার কথাও বলেন। মন্ত্রণালয় ও বিভাগসমূহের জনবল ও সাংগঠনিক কাঠামো (অর্গানোগ্রাম) হালনাগাদ করা হবে।

বাস্তবে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, মন্ত্রীর দপ্তর থেকে উল্লিখিত বিষয়ে কোনো নির্দেশনা দেওয়া হয়নি। মন্ত্রণালয়ের অধীনস্থ সরকারি যানবাহন অধিদপ্তরের কমিশনার আবুল হাছনাত মো. হুমায়ুন কবির যুগান্তরকে বলেন, সমাপ্ত প্রকল্পের গাড়ি কেউ জমা দিলে আমি জমা নিই। এর বাইরে আমি আর কোনো কিছুই জানি না। 

এক প্রশ্নের জবাবে কমিশনার বলেন, সমাপ্ত প্রকল্পের গাড়ি জমা নেওয়ার জন্য নতুন করে কোনো নির্দেশনা আমি মন্ত্রণালয় থেকে পাইনি। মন্ত্রণালয়ের এপিডি ও সিপিটি অনুবিভাগের উচ্চপদস্থ একাধিক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে যুগান্তরকে বলেন, আন্তঃক্যাডার বৈষম্য দূরীকরণে কোনো নির্দেশনা তাদের দেওয়া হয়নি। 

বাজারে সব ধরনের ওষুধের মূল্য দিন দিন বেড়েই চলছে। ভেজাল ওষুধে বাজার সয়লাব। সরকারি হাসপাতালে সেবা নিতে আসা রোগী হয়রানি নৈমিত্তিক বিষয়ে পরিণত হয়েছে। বেসরকারি হাসপাতালে উচ্চমূল্য পরিশোধ করেও প্রত্যাশিত সেবা পাচ্ছে না রোগীরা। অননুমোদিত ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারে সয়লাব। 

সরকারি হাসপাতালে পরীক্ষা-নিরীক্ষার যন্ত্রপাতি অকেজো। যন্ত্রপাতি চালানোর মতো অপারেটর নেই। সরকারি হাসপাতালে রোগীদের নিম্নমানের খাবার সরবরাহের অভিযোগও পুরোনো। গত এক মাসে এসবের কোনো পরিবর্তন হয়নি। 

আবার মন্ত্রীদের কেউ কেউ নতুন কিছুর সূচনা করেছেন। যেমন পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক মন্ত্রী সাবের হোসেন চৌধুরী ইতোমধ্যে ১০০ দিনের কর্মসূচি ঘোষণা করেছেন। তিনি পলিথিনের বিকল্প নিয়ে ভাবছেন এবং তা নিয়ে গবেষক বিজ্ঞানীদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন। 

সিঙ্গেল ইউজ বা একবার ব্যবহারযোগ্য প্লাস্টিক পণ্য উৎপাদনের কাঁচামাল আমদানি নিয়ে কাজ করছেন। ইটের ভাটা উচ্ছেদের পরিকল্পনা বাস্তবায়নে আটঘাট বেঁধে মাঠে নামছেন। তিনি যুগান্তরকে বলেন, আমরা ভালো কিছু করার লক্ষ্যে মাঠে নামছি। চোখ রাখুন কী করি। 

সমাজকল্যাণমন্ত্রী ডা. দীপু মনি দায়িত্বভার গ্রহণ করেই বয়স্কদের জন্য ডে-কেয়ার সেন্টার চালুর উদ্যোগ নিয়েছেন। কর্মজীবীদের বৃদ্ধ পিতা-মাতার দেখভাল হবে ডে-কেয়ার সেন্টারে। যারা কর্মব্যস্ততার জন্য মা-বাবাকে দিনের বেলায় দেখাশোনা করতে পারেন না বা দেখা শোনার মতো পরিবারে কেউ নেই, এমন ব্যক্তিদের ডে-কেয়ার সেন্টারে রাখা যাবে। 

গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রী র আ ম ওবায়দুল মোক্তাদির চৌধুরী দায়িত্বভার গ্রহণ করেই শহরের পাশাপাশি গ্রামে পরিকল্পিত ঘর-বাড়ি নির্মাণের ওপর জোর দিয়েছেন। তিনি নিজ উদ্যোগে স্থানীয় সরকার, কৃষি এবং পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক মন্ত্রীকে আধা সরকারিপত্র (ডিও) দিয়ে কৃষি জমি রক্ষায় পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। কারণ কৃষি জমি হারিয়ে গেলে একদিকে যেমন খাদ্য সংকট হবে, তেমনিভাবে অপরিকল্পিত ঘরবাড়ি তৈরির ফলে গ্রামের পরিবেশও বিনষ্ট হবে।

লোকসানে থাকা টেলিটক, বাংলাদেশ টেলিকমিউনিকেশন্স কোম্পানি লিমিটেড (বিটিসিএল) ও টেলিফোন শিল্প সংস্থাকে (টেশিস) সেবরকারি ব্যবস্থাপনায় দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে ডাক, টেলিযোগাযোগ ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়। অব্যাহত লোকসানের কারণে এ ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। বর্তমানে টেলিটকের কাছে বিটিআরসির পাওনা প্রায় এক হাজার ৮শ কোটি টাকা। টেশিসের আয় ও ব্যয়ের হিসাবে ব্যাপক গরমিল। 

প্রতিষ্ঠানটি এফডিআর ভেঙে কর্মচারীদের বেতন-ভাতা দিচ্ছে। অপরদিকে বিটিসিএল-এর কাছে বিটিআরসির পাওনা প্রায় ১ হাজার ১শ কোটি টাকা। ধারাবাহিক লোকসান থেকে বাঁচতে সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় তিনটি প্রতিষ্ঠানকে বেসরকারি মালিকানায় ছেড়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন জুনায়েদ আহমদ পলক।

image

Leave Your Comments